Space for ads

অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধার কারণে দেশে রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে

 প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন   |   চিকিৎসা

অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধার কারণে দেশে রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে
Space for ads

বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে ক্যান্সার আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে এখানে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে প্রতি এক লাখে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬। প্রতি বছর এ রোগে নতুন করে ৫৩ জন আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের জন্য দায়ী ক্যান্সার। ওই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, দেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি ও জরায়ুমুখের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যাই বেশি।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে এ অসংক্রামক রোগটির চিকিৎসার সুবিধা অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ২০০ চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। সেখানে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৩০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। কিছু কিছু সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সারের রেডিওথেরাপির জন্য বাংকার রয়েছে। তবে সবগুলোয় মেশিন নেই। গত মাসে ‘‌সার্কভুক্ত দেশগুলোয় ‌ক্যান্সার চিকিৎসার বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আছে মোট ২৪টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। এর ১৫টি সরকারি ও নয়টি বেসরকারি। এছাড়া দেশের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য দরকার ১৮০-২০০টি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন। সে তুলনায় আছে মোটে ১৮-২০টি। সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন আছে শুধু জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে। তবে বর্তমানে সেখানকার একটি মেশিনও চালু নেই। এদিকে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় তা বেশ ব্যয়বহুল।
চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার পাশাপাশি ক্যান্সার আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ জনসাধারণের মধ্যে রয়েছে এটি প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সচেতনতার অভাব। ক্যান্সারের উপসর্গ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় অধিকাংশ মানুষের ক্যান্সার শনাক্ত হয় দেরিতে তথা তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে এবং সেই সময় চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়। ফলত অবস্থা ততদিনে বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং নিরাময় কঠিন হয়ে ওঠে। আবার এই দেরিতে রোগ নির্ণয় হওয়ার পেছনে দেশের চিকিৎসা কাঠামোর দায়ও কম নয়। বিশেষত চিকিৎসার সুযোগের অভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শনাক্তের হার কম হলেও মৃত্যুর হার বেশি হয়। এমন অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থায় জনগণ নিজেরা সচেতন হলে এটি প্রতিরোধ বা প্রাথমিক পর্যায়েই তা নিরাময় সহজ হবে।
সুতরাং ভবিষ্যতে ক্যান্সার আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হলে সচেতনতা বাড়ানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি ক্যান্সার চিকিৎসা দেশেই সহজ ও সুলভ করা আবশ্যক। এসব উদ্যোগ দ্রুততার সঙ্গে নেয়া উচিত। নয়তো জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি আরো বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ, যা ২০৩৫ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৭২৬ জনে। এ অবস্থা এড়াতে হলে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
ক্যান্সার প্রতিকার ও প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই সেটি আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে দেশের কমিউনিটি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোয় ক্যান্সারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ নিয়ে সভা-সেমিনার হতে পারে। এতে সচেতনতা বাড়বে, পাশাপাশি রোগীদের সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা যাবে। এছাড়া রোগীকে তার চিকিৎসার জন্য যে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো রয়েছে, যেমন সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, হরমোন থেরাপি ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। যথাযথ কাউন্সেলিং ছাড়া রোগীর মনে ভীতি জন্মাতে পারে। ফলে রোগী মনোবল হারিয়ে ফেলবে। প্রতিটি চিকিৎসা ব্যবস্থার সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রোগীকে ও তার পরিবারকে জানাতে হবে। এছাড়া রোগীর খাবারদাবার কেমন হবে সে ব্যাপারেও সচেতন থাকা জরুরি। এগুলোর সঙ্গে এ বছর থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ক্যান্সার দিবসের জন্য নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের বিষয়টি জড়িত।
নতুন প্রতিপাদ্যটি হলো ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’। অর্থাৎ প্রতিটি রোগীর ক্যান্সারের ধরন আলাদা এবং তাদের সংগ্রামও ভিন্ন। সবার কথা বিবেচনায় রেখেই এমন সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে এটি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় তুলনামূলক সহজেই।
এর পাশাপাশি চিকিৎসার পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের (বিওটিওএফ) হিসাবে, প্রতি বছর গড়ে আট লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়, যাদের সিংহভাগই ক্যান্সার রোগী। তাদের বিদেশে যাওয়ার প্রধান কারণ এখানে এ রোগের চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। আবার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যয়ে রয়েছে বড় ব্যবধান। যেখানে সরকারি হাসপাতালগুলোয় রেডিওথেরাপির খরচ ১৫-৩০ হাজার টাকা, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় এ খরচ পৌঁছায় ১ থেকে ৩ লাখ টাকায়। সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষার খরচও অনেক বেশি। তুলনামূলকভাবে ভারতে এ খরচ অনেক কম হওয়ায় রোগীরা সেখানে যেতে আগ্রহী হয়। কিন্তু বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের মেডিকেল ভিসা পেতেও এখন নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এতে এক ধরনের দিশেহারা হয়ে পড়েছে রোগীরা। আটকে আছে অনেক রোগীর ফলোআপ। অথচ দেশে সুলভে সুচিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থাকলে ক্যান্সার রোগীদের বিদেশমুখিতার কোনো প্রয়োজনই পড়ত না। অবকাঠামোগত সংকট, জনবলের অভাব এবং উচ্চ ব্যয়ের কারণে সুচিকিৎসা পাওয়া থেকে রোগী বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় ক্যান্সার দিবস। গত বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’। অর্থাৎ ক্যান্সার রোগীর সুস্থকরণে সব বাধা অতিক্রম করতে হবে। সচেতনতা থেকে শুরু করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, ক্যান্সার ভালো হওয়ার পর পুনরায় দানা বাঁধে শরীরে। এর কারণ চিকিৎসা-পরবর্তী ফলোআপ সম্পূর্ণ না করা। রোগীর নিয়মিত ফলোআপ বিষয়েও সচেতন হতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্য ও আর্থিক দিক থেকে স্বস্তি দিতে দেশেই সাশ্রয়ী ও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে তাই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া বিশেষ প্রয়োজন।

BBS cable ad

চিকিৎসা এর আরও খবর: