প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা দেয়ার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৫৯% চিকিৎসক পদই ফাঁকা

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০ রোগী ভর্তি থাকে। এর বিপরীতে নিয়মিত চিকিৎসক রয়েছেন কেবল তিনজন। তাদের মধ্যে আবার কেউ না কেউ প্রায়ই ছুটিতে কিংবা অন্যান্য কারণে অনুপস্থিত থাকছেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটছে রোগী। উপজেলাভিত্তিক প্রায় সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই এ চিত্র।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর প্রায় ৫৯ শতাংশ চিকিৎসক পদই ফাঁকা। সবচেয়ে বেশি পদ শূন্য বরিশাল ও রংপুর বিভাগে। পদায়ন করা হলেও এসব অঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকরা বেশি দিন থাকতে চান না বলে অভিযোগ। ফলে বরিশালে ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ পদই শূন্য। রংপুরে ৭০ শতাংশ পদের বিপরীতে চিকিৎসক নেই। এছাড়া খুলনা বিভাগে ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ চিকিৎসক পদ ফাঁকা পড়ে আছে। সে তুলনায় ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিত্র কিছুটা ভালো। এ দুই বিভাগে চিকিৎসকের শূন্য পদের হার যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ৩ ও ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ।
চিকিৎসকসহ প্রায় সব সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধেই প্রধান অভিযোগ, তারা ঢাকায় থাকতে চান। ফলে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদের তুলনায় বেশি চিকিৎসক কর্মরত। এর পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ পদই শূন্য পড়ে আছে। সব মিলিয়ে দেশের উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ পদে কোনো চিকিৎসক কর্মরত নেই। সে হিসাবে অর্ধেকেরও কম চিকিৎসক নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় জনবল সংকটের সমস্যা অনেক পুরনো। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের মানুষ যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। অনেক স্থানে আবার কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। জুনিয়র চিকিৎসকরা তাই প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও রোগীদের জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ফলে সদর হাসপাতালগুলোয় সবসময়ই সক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি থাকে। অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে রোগীর তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে প্রায়ই চিকিৎসক না থাকায় অনেক রোগীর মৃত্যুও হয়।
রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলা দিনাজপুর। এ জেলার ১৩টি উপজেলায় ১১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১০২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ৩০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সেবা কেন্দ্রেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কনসালট্যান্ট, সিনিয়র চিকিৎসক, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তীব্র সংকট। এর মধ্যে ফুলবাড়ীর ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীসহ সরকারি মঞ্জুরীকৃত পদ ১৮২টি। অথচ এর প্রায় অর্ধেক পদই বছরের পর বছর ধরে ফাঁকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মশিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কার্যত মাত্র তিনজন চিকিৎসক দিয়ে হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে। জরুরি বিভাগ বলতে গেলে একদম জনবলশূন্য—ডাক্তার, ওয়ার্ড বয়, সুইপার কোনো কিছুই নেই। ফলে অন্তঃবিভাগের জনবল দিয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে।’
চিকিৎসক ও মিড লেভেলের কর্মকর্তা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে বহুবার আবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান ডা. মশিউর রহমান। অনেকটা আক্ষেপের সুরেই এ চিকিৎসক কর্মকর্তা বলেন, ‘আর কতবার লিখব? তারা তো ডাক্তার নিয়োগ দেয় না। কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফুলবাড়ীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো জেলার প্রায় সব হাসপাতালেই জনবল সংকট। এভাবে জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রংপুর বিভাগে উপজেলাভিত্তিক চিকিৎসক পদের সংখ্যা ১ হাজার ১৬১। এর মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন কেবল ৩৪৮ জন। বাকি ৮১৩টি পদই এখন ফাঁকা পড়ে আছে।
রংপুর বিভাগের চিকিৎসার বেহাল দশার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায় পঞ্চগড় জেলার ভজনপুর ইউনিয়নের খালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুনা আক্তারের কথায়। তিনি বলেন, ‘আমার ১০ মাস বয়সী ছেলে ওয়াসিম দীর্ঘদিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। কিন্তু যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় নিয়ে এসেছি। ১১ দিন ধরে মিরপুরের লালকুঠি মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে।’
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মানুষের চিকিৎসার প্রধান ভরসাস্থল হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসকের সংকট থাকায় রোগীরা প্রতিনিয়তই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে এ হাসপাতালে নেই গাইনি চিকিৎসক। সার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই তিন বছর ধরে। দুজন মেডিকেল অফিসার নেই ছয় মাস হলো। এমনকি হাসপাতালে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদটিও গত মাস থেকে খালি। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর ৪৮টি পদ থাকলেও অর্ধেকেরও বেশি শূন্য।
হারাগাছ ইউনিয়নের চর নজিরদহ গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। হার্নিয়ার ব্যথা নিয়ে তিনি সম্প্রতি হারাগাছ হাসপাতালে যান। কিন্তু সার্জারি চিকিৎসক না থাকায় বাধ্য হন ধারদেনা করে রংপুরে চিকিৎসা করাতে।
চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে এমন জেলাগুলোর একটি বান্দরবান। পার্বত্য এ জেলার সদর হাসপাতালসহ ছয় উপজেলা স্থাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকসহ তিন শতাধিক জনবল সংকট বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। রোয়াংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩টি পদের মধ্যে সাতটি পদই শূন্য। থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ ১২টির মধ্যে আটটি পদই ফাঁকা। লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৩টি পদের মধ্যে ১৪টি ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২টি পদের সাতটিই শূন্য। জনবল সংকটের মধ্যেও সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. মো. শাহীন হোসাইন।
খুলনা বিভাগের উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১ হাজার ৩২৭টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ৮৯৬টিই শূন্য। এ বিভাগের জেলা বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মাত্র চারজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা।
কচুয়া উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন ওবায়দুল হক বলেন, ‘প্রসবজনিত কারণে আমার স্ত্রী গত মঙ্গলবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। সেখানে কর্তব্যরত একজন নার্স গাইনি ওয়ার্ডে পাঠান। কিন্তু গিয়ে কোনো চিকিৎসকই পাইনি। রাতভর আমার স্ত্রী ব্যথায় চিৎকার করেছে। পরদিন সকাল ৮টায় একটি স্যালাইন দিয়ে বলা হয়—এখানে সিজার হবে না, অন্য কোথাও নিয়ে যান।’
চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীরা ঠিকমতো সেবা না পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মনিশঙ্কর পাইক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের ২৯ জনের পদ থাকলেও সেখানে মাত্র দুজন মেডিকেল অফিসার, একজন অ্যানেসথেসিয়া ও একজন ডেন্টাল চিকিৎসক রয়েছেন। তাই স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।’ বাগেরহাটের বাকি সব উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিত্রও প্রায় একই বলে জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বিসিএসের মাধ্যমে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের জন্য এরই মধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিসিএস থেকে আরোপ সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসক নেয়ার পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে একাডেমিক পদায়নের জন্যও সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করছে বলে জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে এ উদ্যোগের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
স্বাস্থ্য খাতে জনবল বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। গ্রামের মানুষরা এখান থেকে সেবা পান। এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর অধীনে পরিবার-পরিকল্পনাকেন্দ্রিক আরো অনেক কাজ থাকে। জনবল সংকট থাকলে এ কাজগুলোও বিঘ্নিত হয়। অথচ এমবিবিএস পাস করার পর চিকিৎসকদের একটা অংশ বেকার বসে থাকছেন। এ কারণে চিকিৎসকদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কিন্তু বাড়ছে। আবার চিকিৎসকদের একটি অংশ বিসিএসের মাধ্যমে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য খাতে জনবল বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সবার আগে দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক কত হওয়া দরকার সেটির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জরুরি।’