বরিশালে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে ছয় গুণ
অন্য সময়ের তুলনায় শীত মৌসুমে দেশে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে বরিশালে নভেম্বরের শুরু থেকেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য বলছে, আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহারও বেড়েছে। চলতি বছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ৪৫৭টি শিশু। এর মধ্যে মারা গেছে ১৩৫ জন। গত বছর ৭ হাজার ২৬৬টি শিশু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় ২২ জনের। সে হিসাবে এক বছরে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে ছয় গুণ।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় এক লাখ শিশু মারা যায়। এর মধ্যে ২৪ হাজারের (২৪ শতাংশ) মৃত্যু হয় শুধু নিউমোনিয়ায়। সারা পৃথিবীতে এ হার ১৪ শতাংশ। অসচেতনতার কারণেই এমনটি হচ্ছে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসায় কোনো গাফলতি করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বরিশালে নিউমোনিয়ায় শিশু আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বাড়ছে। অনেকেই নিজেদের সিদ্ধান্তে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। প্রতিদিন আমরা গড়ে ৩৮১টি শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে আসছি। এজন্য অভিভাবকদের অসচেতনতা দায়ী। শীতের শুরুতে রোগটি বেশি হলেও সচেতনতা বাড়ছে না।’
আক্রান্ত শিশুদের মায়েরা বলছেন, জ্বর-সর্দির সঙ্গে শিশুর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। নভেম্বরের শুরু থেকেই গ্রামের শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ২১ মাস বয়সী শিশু সারার বাবা সুমন বলেন, ‘মেয়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, বুকে কফ জমে গিয়েছিল। খাবার খাচ্ছিল না, শুধু কান্নাকাটি করছিল। পরীক্ষার পর নিউমোনিয়া ধরা পড়ে।’
শিশুদের স্বজনরা বলছেন, দিনে গরম আর রাতে ঠাণ্ডায় শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েও উন্নতি হচ্ছে না।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত মুমূর্ষু শিশুদের সাধারণত পেডিয়েট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) রেখে চিকিৎসা করা হয়। যেটিকে বলা হয় শিশুদের আইসিইউ। তবে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে স্থাপন করা হয়নি অত্যাবশ্যকীয় ইউনিটটি। বাধ্য হয়ে চিকিৎসকরা রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে গিয়ে কখনো কখনো শিশুর মৃত্যুও হচ্ছে।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশুদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া অত্যাবশ্যক। বরিশালে এ সেবা না থাকায় চিকিৎসকরা বাধ্য হয়ে রোগীদের ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। এতদিন পেডিয়াট্রিক আইসিইউতে দৃষ্টি দেয়া হয়নি। নবজাতক ও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মৃত্যু কম হওয়ায় নজর এড়িয়ে গেছে। একজন শিশুর মৃত্যুও কাম্য নয় উল্লেখ করে সীমিত পর্যায়ে সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পিআইসিইউ স্থাপন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৪৮টি শয্যার বিপরীতে এখন ভর্তি রয়েছে তিন শতাধিক শিশু। এক শয্যায় দুই-তিনজন রোগী রাখতে হচ্ছে। আমাদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে, ওষুধও দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য পাঁচ শয্যার আইসিইউ চালু করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি চালাচালি চলছে। এজন্য আমরা এরই মধ্যে একটি কক্ষ নিয়ে অবকাঠামো প্রস্তুত করেছি। এটা হলে সেবা আরো দ্রুত দেয়া যাবে।’
সার্বিক বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিউমোনিয়া শনাক্ত করে চিকিৎসা দেয়ার জন্য আমাদের তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষ চিকিৎসকসহ দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। পর্যাপ্ত ওষুধও রয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের এ সময়ে শ্বাস প্রদাহজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব এখানে রয়েছে। আমরা চিন্তিত, তবে রোগ প্রতিরোধে বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতেও আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন।’