Space for ads

লাগামহীন ওষুধের বাজার, রোগীদের হাঁসফাঁস অবস্থা

 প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ পূর্বাহ্ন   |   চিকিৎসা

লাগামহীন ওষুধের বাজার, রোগীদের হাঁসফাঁস অবস্থা
Space for ads
নিত্যপণ্যের মতোই লাগামহীন হয়ে পড়েছে দেশের ওষুধের বাজার। বাঁচতে হলে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের এখন শুরু হয়েছে হাঁসফাঁস অবস্থা। চাল, ডাল, মাংস ও ডিমসহ  নানা নিত্যপণ্যের দামের মতো ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে জীবন বাঁচাতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম। পকেট কাটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। গত কয়েকদিনে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ওষুধের দাম। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, বিভিন্ন ধরনের  ইনজেকশন, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিকসের ওষুধ। আর ওষুধের দাম বেড়েছে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।

শুক্রবার সরেজমিনে রাজধানীর নাজিরা বাজার, আনন্দবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, শাহবাগ এবং বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ওষুধ ফার্মেসি ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।  

পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় এবং যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাপক হারে বাড়ছে ওষুধের দাম। আবার দাম বাড়ার কারণে দোকানদাররাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। অনেক সময় কাস্টমারদের সঙ্গে দাম নিয়ে তর্ক-বিতর্কও করতে হয় এবং দোকানদারদের কৈফিয়ত দিতে হয়।

তবে ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে ডলারের দাম, ওষুধের কাঁচামালের দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ আছে প্রায় জেনেরিকের। যার মাত্র ৩ শতাংশের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে সরকারের। অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের ধারা অনুযায়ী সরকার কেবল ১১৭টি ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে সে তালিকায় নেই গ্যাস্ট্রিক, হৃদরোগ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো নিত্যব্যবহৃত ওষুধগুলো। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমতো মুনাফা করছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন সরকারের নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শুক্রবার সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, ১৫ দিন আগে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের নাপা ১০ এমএল আইভি ইনজেকশনের দাম ছিল ১১০ টাকা। তা এখন ৪০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। অর্থাৎ বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ কোম্পানির ট্যাবলেট আলসার রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসিফিক্স প্রতি পিস ৭ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০টির এক পাতার দাম ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকায় বিক্রি করতে গেছে। বেড়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত একই কোম্পানির ট্যাবলেট  রসুটিন এক বক্স ৩০টির দাম ৩৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।

ওই একই রোগের পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ট্যাবলেট রসুভাস্টাটিনের দাম প্রতি এক পাতা ১০টির দাম ১৬৫ টাকা থেকে ১৮০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ৯ শতাংশের ওপরে।
 
এরিস্টোফার্মা লিমিটেড কোম্পানির ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বহুল ব্যবহৃত ট্যাবলেট লিনাগ্লিপের দাম প্রতি পিস দুই টাকা বেড়েছে। আগে এক পাতা ১০টির দাম ছিল ২০০ টাকা। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। বেড়েছে ১০ শতাংশ। একই কোম্পানির চোখের সমস্যাজনিত ড্রপস অপটিমক্স ৫ এমএলের দাম ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এর দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল্স পিএলসি কোম্পানির উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যামলোসার্ট ট্যাবলেট এক পাতা ১০টির দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়েছে। একইভাবে একই কোম্পানির ঘুমের সমস্যাজনিত চিকিৎসায় ব্যবহৃত  ল্যাক্সিল ৩ মিলিগ্রামের দাম ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭ টাকা করা হয়েছে।

ওষুধের দাম বাড়ার ব্যাপারে রাজধানীর নাজিরা বাজার এলাকার সুলতান ফার্মেসির এক কর্মচারী  বলেন, প্রতিদিনই বাজারে কিছু না কিছু ওষুধের দাম বাড়ে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে কিছু কম বেড়েছে। যেহেতু দেশের মধ্যে নতুন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই হয়তো এখনও সেভাবে তেমন কোনো ওষুধের দাম বাড়ছে না।

বংশালের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী সালাম শিকদার  বলেন, আমিও ১২ বছর ধরে ডায়াবেটিসের রোগী। দুই বেলা ইনসুলিন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতিবার এসে দেখছি কোনো না কোনো ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। আগে যে টাকায় ওষুধ কিনতাম এখন তা দিয়ে হচ্ছে না। আমাদের খরচের একটা নির্দিষ্ট হিসাব থাকে। এখন সামনে রাস্তা একটাই তা হলো হয় ওষুধে কাটছাঁট করা, নয়তো খাবার কেনা কমিয়ে দেওয়া।

এখন প্রতি মাসে ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ওষুধের পেছনে আগের দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
রাজধানীর আনন্দবাজার এলাকার সার্জিক্যাল মেডিসিন ওষুধের দোকানের কর্মচারি হীরা রহমান বলেন, বাজারে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক ওষুধের দাম বেড়েছে। আবার কোনও কোনও ওষুধের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট ও বিভিন্ন ইনজেকশনের দাম। দাম বাড়ার কারণে অনেক সময় কাস্টমারদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। তখন তারা বলেন, আমরা ডাকাতি শুরু করেছি। কিন্তু এখানে আমাদের তো করার কিছু নেই। ওষুধের প্যাকেটের গায়ের মূল্য যা থাকে আমরা সে দামেই বিক্রি করি। প্রয়োজনে অনেক ছাড় দেওয়া হয়।

ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে আজিজ কো-অপারেটিভ ওষুধ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন তা নেই। আর এটি না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কঠোর নজরদারি বাড়ানোসহ কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে কখনোই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, রোগীর জীবন রক্ষায় ওষুধ অপরিহার্য। আর ওষুধ তো আর চাল-ডালের মত নয়, যে বেশি দামেরটা না কিনে কম দামে খাওয়া যায় অথবা অল্প পরিমাণে খেয়ে থাকা যায়। চিকিৎসক যেভাবে প্রেসক্রাইব করবে সেভাবেই রোগীকে খেতে হবে। তা না হলে অসুখ তো সারবে না বরং আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। তাই  জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধকে অত্যাবশ্যক তালিকায় রেখে এগুলোর দাম যেন না বাড়ে সে জন্য সরকারের উচিত হস্তক্ষেপ করা। তা না হলে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়তির কারণে  স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওষুধের দাম কি নিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে? আর নিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ার জন্য সরকার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর করেছে। পুরো পৃথিবীজুড়ে ওষুধের দাম নির্ধারণে একটি আলাদা ব্যবস্থাপনা বা অথরিটি আছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। বর্তমানে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সরকার নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলেও বেশির ভাগ ওষুধের দাম ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে, যা ইন্ডিকেটিভ প্রাইজ হিসেবে অভিহিত হয়। তাই সব ধরনের ওষুধের দাম সরকার নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলে ওষুধের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।


BBS cable ad