ভয়াবহ হচ্ছে ডেঙ্গু, ‘হটস্পট ম্যানেজমেন্ট’ না হলে বিপর্যয়ের শঙ্কা
দেশজুড়ে ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মৃত্যু হয়েছে দুজনের।
চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট ২৬ হাজার ৫৫৫ জন। মারা গেছেন ১৩৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন ১০৫৫ জন, মারা গেছেন ১৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৩৩৯ ও তিন; মার্চে ৩১১ ও ৫; এপ্রিলে ৫০৪ ও দুই, মে মাসে ৬৪৪ ও ১২; জুনে ৭৮৯ ও ৮; জুলাইয়ে ২২৬৯ ও ১২, আগস্টে ৬৫২১ ও ২৭ এবং সেপ্টেম্বরে এখন পর্যন্ত ১৩৭১৪ ও ৫৫।
এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয়কে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে মশকনিধন কার্যক্রম না করা, ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমে ভাটা পড়া, মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসকদের অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অক্টোবরে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে এর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও এর বাইরে জেলাগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করা জরুরি। নয়ত সামনের দিনগুলোয় বড় ধরণের বিপর্যয় হতে পারে।
২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলে ৮৬৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে বছর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে আক্রান্ত ও মৃত্যু হার কম ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
কীটতত্ত্ববিদরা আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, বর্ষা মৌসুম শেষ হলে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। আমরা এটাকে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, সামনের দিনগুলোয় এডিস মশার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এবারের বর্ষা মৌসুমে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রায় এডিস মশা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে কি না, জানতে চাইলে কবিরুল বাশার বলেন, এমন তাপমাত্রা ডেঙ্গু বৃদ্ধিতে সহায়ক। সামনের দিনগুলোয় ডেঙ্গু বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এডিস মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে গেলেই বলা হয়, এ রোগের প্রকোপ বাড়বে। ঢাকা শহরের প্রায় সব জায়গায় এডিস মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে। ঢাকার আশপাশ ও দেশের অন্যান্য বেশ কিছু বিভাগেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ দেখ যাচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিষয়ে এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করা দরকার। অর্থাৎ, ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করতে হবে। এসব ঠিকানায় গিয়ে আক্রান্তদের বাড়ি ও আশপাশে ফগিং করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ, ডেঙ্গুরোগীর বাড়ির মশাগুলো ইনফেক্টেড। তাই এসব মশা যদি বেঁচে থাকে বা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে ডেঙ্গু রোগও ছড়াবে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট শুরু করা দরকার। পাশাপাশি নাগরিকদেরও তাদের ঘর, বাড়ির আঙ্গিনায় যেন এডিস মশার প্রজনন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেশের হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিজ কন্ট্রোল বিভাগের পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, হাসপাতালগুলো প্রস্তুত। ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। বড় হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। ওষুধ পত্রসহ ও ডেঙ্গু টেস্টের সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ডেঙ্গু রোগী আরও বাড়লে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০০ জনের মধ্যে যদি সবারই ডেঙ্গু হয়, তাহলে কি রোগী ফেরান যাবে? তাদের ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। যা যা প্রয়োজন সবই করতে হবে।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। তিনি বলেন, লোক দেখানো কাজ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের সচেতন থাকাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।