কাগজে-কলমে হাজারের বেশি অ্যাম্বুলেন্স, সচল ৫৫০
স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেশের তৃণমূলের মানুষের ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উপজেলা পর্যায়ে সরকারি চিকিৎসার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। শুধু চিকিৎসা নয়, উপজেলার বাসিন্দাদের রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনায়ও ভূমিকা রাখে এসব প্রতিষ্ঠান। সংকটাপন্ন রোগীদের পরিবহনের জন্য সারা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা হাজারের বেশি। তবে এ হিসাব শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবতা হচ্ছে অর্ধেক অ্যাম্বুলেন্সই অচল। তাই রোগীদের নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য যানবাহনের ওপর।
এ অচলাবস্থার জন্য চালক পদে নিয়োগ না থাকা, যান্ত্রিক ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রাশাসনিক ৪৯২ উপজেলার মধ্যে ৪২৭টিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব হাসপাতালে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি। এর মধ্যে সচল ৫৪৯টি। বাকি ৫২০টির মধ্যে মেরামত যোগ্য অচল ৩১৪টি ও মেরামত অযোগ্য অচল ২০৬টি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় একটি করে অ্যাম্বুলেন্স চালকের পদ রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা (ইউএইচসি) শাখা। তবে কিছু হাসপাতালে চালকের পদ শূন্য। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চার বছর অ্যাম্বুলেন্স চালকের পদ শূন্য। বাগমারা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম রাব্বানী বণিক বার্তাকে জানান, অ্যাম্বুলেন্সের আগের চালক অবসরে গেলে নতুন চালক নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে প্রায়ই তার চালক দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স চালানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা (ইউএইচসি) ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখার তথ্য অনুযায়ী, বিভাগভিত্তিক হিসাবে ঢাকার ৭৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সবচেয়ে বেশি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। বিভাগটিতে ১১৯টি সচল অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। তবে আট বিভাগের মধ্যে অচল অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এ বিভাগে। মেরামত যোগ্য অচল ৬৬টি আর মেরামত অযোগ্য অচল ৩৮টি।
রাজশাহীর ৫৯ উপজেলা হাসপাতালে সচল অ্যাম্বুলেন্স ৮৪টি, মেরামত যোগ্য অচল ৪২টি ও মেরামত অযোগ্য অচল ৩৪টি; সিলেট বিভাগে ৩৬ উপজেলা হাসপাতালে ৪১টি সচল অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও মেরামত যোগ্য অচল ২৪টি আর মেরামত অযোগ্য অচল ১৫টি; খুলনা বিভাগের ৫০ উপজেলা হাসপাতালে ৬১টি সচল অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এ বিভাগে মেরামত যোগ্য অচল ৩৩টি ও মেরামত অযোগ্য অচল ১৭টি। বরিশাল বিভাগে ৩৫টি উপজেলা হাসপাতালে সচল ৪৯টি, মেরামত যোগ্য অচল ১৩টি ও মেরামত অযোগ্য অচল ২১টি অ্যাম্বুলেন্স।
চট্টগ্রাম বিভাগের ৯২টি উপজেলা হাসপাতালে ১০০ সচল অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি মেরামত যোগ্য অচল ৬০টি এবং মেরামত অযোগ্য ২৯টি, ময়মনসিংহ বিভাগের ২৯ উপজেলা হাসপাতালে ৩৩টি সচল অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও মেরামত যোগ্য অচল ২৯ ও মেরামত অযোগ্য অচল ২৩টি। রংপুর বিভাগের ৫০ উপজেলা হাসপাতালে সচল অ্যাম্বুলেন্স ৬২টি। এ বিভাগে মেরামত যোগ্য অচল ৪৭টি ও মেরামত অযোগ্য অচল অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ২৯টি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপজেলা বা জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোয় অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হলে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মেরামত করতে পারেন। মেরামত করার জন্য অ্যাম্বুলেন্সপ্রতি উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কর্মকর্তার ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার ক্ষমতা রয়েছে। এর বেশি হলে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতের দায়িত্বে নিয়োজিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইন্টেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিও অ্যান্ড টিসি) মেরামত করে দেয়। এক্ষেত্রে বিআরটিএর অনুমোদন প্রয়োজন। যেসব অ্যাম্বুলেন্স মেরামত অযোগ্য, সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটি নিলাম করে দেয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছু অ্যাম্বুলেন্স ২০০০ সালেরও আগের। এগুলো মেরামত করে চালানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও আমরা নতুন অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছি। আগের অ্যাম্বুলেন্সগুলোয় রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি ব্যয় অনেক বেশি। বর্তমানে কোনো কোনো উপজেলা হাসপাতালে দু-তিনটি করেও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। উপজেলাগুলোয় অ্যাম্বুলেন্স একটি থাকার কথা, একটি চালকের পদ রয়েছে। তিন-চারটি অ্যাম্বুলেন্স রাখারও তাদের ব্যবস্থা নেই।’
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তা মেরামত করে নিমিও অ্যান্ড টিসি। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যলয় নেই, পর্যাপ্ত লোকবলও নেই। এতে দীর্ঘ হয় মেরামত প্রক্রিয়া।
সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সেবা না পেলে রোগীর ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বাড়ে বলে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওষুধে রোগীদের আউট অব পটেক এক্সপেন্ডিচার (বাড়তি ব্যয়) সবচেয়ে বেশি। সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা হয় না। এর সঙ্গে উপজেলা পর্যায়ের কোথাও কোথাও অ্যাম্বুলেন্স অচল থাকায় রোগীদের নিজ খরচে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যেতে হয়। যে জরুরি সরকারি সেবা স্বাভাবিকভাবে পাওয়ার কথা তা যদি বেসরকারিভাবে কিনতে হয় সেখানে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেগুলো মেরামত অযোগ্য, সেগুলো হিসেবেই আসবে না। সরকারি সম্পত্তি অচল হয়ে গেলে তা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাতিল করা হয়। আর যেগুলো মেরামত যোগ্য অচল, সেগুলোকে সচল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সব সময়ই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ে থাকে।’-বণিক বার্তা