Space for ads

চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নাঈম

 প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৫ অপরাহ্ন   |   চিকিৎসা

চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নাঈম
Space for ads

নাঈম শিকদার। খুলনা খালিশপুর সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা মাছের ব্যবসা করে কোনো মতে সংসার চালান। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে নাঈম পরিবারের বড় সন্তান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় ছটপট করে দিন কাটছে তার।

৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পলায়নের আগের দিন ৪ আগস্ট রণক্ষেত্রে পরিণত হয় খুলনার রাজপথ। ঐদিন খুলনা নগর ভবনের সামনের সড়কে দিনভর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলে। পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর মুহুর্মূহু রাবার বুলেট টিয়ার সেল ও শর্ট গানের গুলি ছোড়ে।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পুলিশ খুব কাছ থেকে শর্টগান দিয়ে ছররা গুলি ছোড়ে খালিশপুর সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম শিকদারের ওপর। গুলির স্প্রিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয় নাঈমের সমস্ত শরীর। সাড়ে তিন শতাধিক শর্ট গানের গুলির ছররা তার শরীরে ভেদ করে।

চিকিৎসা নিয়েছেন খুলনা সরকারি মেডিকেল কলেজ, সিটি মেডিকেল কলেজ, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নেভি উপশম মেডিকেল ক্যাম্প ও যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।

গত তিন মাসে উপরোক্ত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়ার পর তার শরীর থেকে মাত্র ২০ থেকে ২৫টা গুলি বের করা হয়েছে। বাকি ছররা গুলিগুলো এখনো তার শরীরে রয়ে গেছে। শরীরে এতগুলো গুলির স্প্রিন্টার নিয়ে গত তিন মাস ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন নাঈম শিকদার।

সর্বশেষ ২০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে আসেন নাঈম। কিন্তু সারা শরীরে ব্যথা, যন্ত্রণা, চামড়ার ভেতরে জ্বালাপোড়া, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট সহ শরীরের চামড়ার ভেতর অসহনীয়, সীমাহীন জ্বালাপোড়া সহ্য করতে না পেরে ১৩ নভেম্বর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্তমানে নাঈম ওই হাসপাতালের ১৪ নম্বর ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান নাঈমের যাবতীয় চিকিৎসা খরচ প্রথমাবস্থায় পরিবারকে বহন করতে হয়। পরবর্তীতে তার চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহন করা হলেও এ পর্যন্ত আর্থিক কোনো সহযোগিতা পাননি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতৃবৃন্দও এ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ খবর নেননি। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান নাঈমের অবস্থা জানতে পেলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে সহযোগিতা করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নাঈম। দৌলতপুর আঞ্জুমান রোডের আমতলায় ছোট একটি ভাড়া বাসায় বাবা-মা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন নাঈম। অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা মাছের ব্যবসা করে কোনো মতে সংসার চালান। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে নাঈম পরিবারের বড় সন্তান। পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে সহযোগিতা করতেন।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে খুলনার রাজপথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় নাঈম। ৪ আগস্ট খুলনা নগর ভবনের সামনে পুলিশের শর্টগানের গুলির ছররায় নাঈমের সমস্ত শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মারাত্মক আহত নাঈমকে আন্দোলনরত অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ধরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দেয়। ছাত্রলীগ কর্মীদের আক্রমণের ভয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক আহত নাঈমকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪ ঘণ্টা পর চিকিৎসা প্রদান করে। এরপর পর্যায়ক্রমে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নেভি উপশম মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নেয় নাঈম। সর্বশেষ যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়ার পর ২০ অক্টোবর বাড়ি ফিরে যান।

নাঈম বলেন, ৪ আগস্ট নগর ভবনের সামনে সড়কের ৫ মিটার সামনে থেকে পুলিশ শর্টগান দিয়ে আমার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় আমার শরীরে ৪ শতাধিক গুলির ছররা ভেদ করে। এরপর থেকে শরীরের ভেতর সীমাহীন জ্বালাপোড়া, যন্ত্রণা শুরু হয়। খুলনার বিভিন্ন হাসপাতাল এবং যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে আমার শরীর থেকে মাত্র ২০ থেকে ২৫ টা গুলি বের করা হয়। বাকি সাড়ে তিন শতাধিক গুলির স্পিন্টার আমার শরীরে এখনো রয়ে গেছে। শরীরের সম্পূর্ণ চামড়া অবশ হয়ে যায়। বুকে, পিঠে, হাতে, পায়ে সমস্ত শরীরে গুলির ছররা। ডান হাতের দুই আঙ্গুলে কোনো কাজ করছে না। কিছু ধরলে মনে হয় কারেন্টের শর্ট লাগছে। হাত দিয়ে কলম ধরতে পারি না। আমার লেখাপড়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শরীরের ভেতর সারাক্ষণ আগুনের মতো জ্বলে। চুলকায়, বিরবির করে। যন্ত্রণায় সারাক্ষণ ছটফট করি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

যশোর সিএমএইচ থেকে পিঠের বড় ক্ষতটার চামড়া প্লাস্টিক সার্জারি করে দিছে। ওখানকার চিকিৎসকরা বলেছেন, আপনার যথাপোযুক্ত চিকিৎসা বাংলাদেশের সম্ভব নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন শরীরের ভেতর থাকা গুলির ছররাগুলো বের করতে হলে চামড়া সম্পূর্ণ কাটা লাগবে। এতে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। দেশের বাইরে এর কোনো চিকিৎসা নেই। গুলি ছররা ভেতরে রেখে সারা জীবন আপনাকে এভাবে বেঁচে থাকতে হবে। শরীরের ভেতর গুলি রেখেই আপনাকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। এতে কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাঈম বলেন, সাড়ে তিন শতাধিক গুলির ছররা শরীরের ভেতর রেখে সারা জীবন আমাকে বেঁচে থাকতে হবে আর এই জ্বালাপোড়া, যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।

আক্ষেপ করে বলেন, নিজের জীবন বাজি রেখে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অথচ আন্দোলনে বিজয় লাভের পরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতা এ পর্যন্ত কোনো খোঁজ খবর নিল না। সরকারিভাবেও এ পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহযোগিতা পেলাম না।

BBS cable ad