Space for ads

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিয়ম-দুর্নীতি করে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ

 প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন   |   স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিয়ম-দুর্নীতি করে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ
Space for ads

জাহিদ মালেক ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই দল থেকে মনোনয়ন ভাগিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর পরপরই জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কামিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, করোনাকালে মুন্সীগঞ্জের একটি কারখানায় এন-৯৫ নকল মাস্ক বানিয়ে ভুয়া আমদানি দেখিয়েছেন। মানহীন মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রী ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দামে সরকারিভাবে সরবরাহ করেছেন তার ছেলে রাহাত মালেক শুভ্রসহ স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্তাব্যক্তিরা। তারা কয়েকজন মিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপের মাধ্যমে গড়ে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, এ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ওষুধ সরবরাহ, বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট খাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন তিনি ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এছাড়া, মন্ত্রণালয়ের বাইরেও জাহিদ মালেক সংসদীয় আসনে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ কয়েক ডজন নেতা নিয়ে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেন তিনি। তার ছেলে রাহাত মালেক একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভয় দেখিয়ে কম টাকায় জমি কেনা, টেন্ডার বাণিজ্য, নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, বালুমহল নিয়ন্ত্রণ, পরিবহনে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিতেন সাবেক এই মন্ত্রীর পরিবার। জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা অনিয়ম-দুর্নীতি করে যেমন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, ঠিক তেমনই তার দলীয় সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

দুর্নীতির এসব টাকা দিয়ে জাহিদ মালেক নামে-বেনামে এক ডজনের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও ঢাকার গুলশানে বাড়ি, বনানীতে ১৪ তলা ও মানিকগঞ্জে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণসহ গ্রামের বাড়ি গড়পাড়ায় মায়ের নামে বিশাল বাগান বাড়ি ও অ্যাগ্রো ফার্ম তৈরি করেছেন। আর নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা-সেমিনার করার জন্য গড়পাড়ায় করেছেন বিশাল মিলনায়তন ‘শুভ্র সেন্টার’। অভিযোগ আছে, মন্ত্রীর মায়ের নামে স্কুল করার কথা বলে স্থানীয়দের সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে জমি দখল করেছেন। জমি নিয়ে ন্যায্য দাম দেননি। কিন্তু স্কুলের পরিবর্তে তিনি গড়েছেন খামার বাড়ি।

জানা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সানলাইফ বিমা কোম্পানিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। তার বোন রুবিনা হামিদের আগে তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রতিষ্ঠানেও তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। যার কারণে সারাদেশের লাখ লাখ গ্রাহক বিমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও একটি টাকা পাননি। এ নিয়ে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করেছেন গ্রাহকরা।

এদিকে, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। অর্থাৎ আইন অনুসারে কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় যে ব্যয় করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় করা এসব টাকার ৯০ শতাংশই বিমা গ্রাহকের জমাকৃত টাকা। এ কারণে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি।

সব শেষ জাহিদ মালেক, তার ছেলে রাহাত মালেক, মেয়ে সিনথিয়া মালেকসহ স্বজনরা জড়িয়ে পড়েন সরকারি ওষুধ কারখানা স্থাপনের জমি অধিগ্রহণ দুর্নীতিতে। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল একনেকে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মানিকগঞ্জের কারখানা স্থাপন প্রকল্পটি পাস হয়। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। জাহিদ মালেক প্রকল্পের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকায় সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করেন।

প্রকল্পের ধারণার শুরু থেকেই সম্পদ বিকাশের উপায় বের করেন জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা। প্রকল্পের জায়গায় তার মেয়ে সিনথিয়া মালেক ১১ একর ১৪ শতক জমি কেনেন। সেই জমি দ্বিগুণ দেখিয়ে তার স্বামীকে দান করেন সিনথিয়া। সরকার এ জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে সর্বশেষ মূল্যের তিনগুণ বেশি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ ৭ কোটি টাকার জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করলে ৪০ কোটি টাকা পাবেন তার মেয়ের জামাই। জাহিদ মালেকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিডি সান লিমিটেডের নামে কেনা হয় ৬ একর ৩৯ শতক জমি। মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের মালিকানাধীন রাহাত রিয়েল এস্টেটের নামে কেনা হয় ৩ একর ১২ শতক জমি। অর্থাৎ সাড়ে ৩১ একর জমির মধ্যে ২০ একর ৬৫ শতাংশ জমি মন্ত্রী, তার ছেলে ও মেয়ে কিনেছেন। এরপর শ্রেণি পরিবর্তন করে একলাফে জমির মূল্য (মৌজা দর) পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, অধিগ্রহণ বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে ১০০ কোটি টাকা বের করে নিতেই তিনি এমন কারসাজির আশ্রয় নিয়েছিলেন।

রফিকুল ইসলাম নামে একজন বলেন, তিনি মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তার পরিবারের সবাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়েন। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পর্যন্ত দেখায়নি। মানিকগঞ্জ ও সাটুরিয়া উপজেলায় তার প্রতিপক্ষ বলতে কিছুই ছিল না। কেউ তার মতের বাইরে গেলে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করতেন।

এলাকার আলম নামের ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তার মায়ের নামে স্কুল করার কথা বলে জুলুম-অত্যাচার করে তার সন্ত্রাসী বাহিনী কম দামে জায়গা নিয়েছেন। পরে সেখানে তিনি ফার্ম বানান। এখনো অনেকে পুরো টাকা পায়নি। তার সকল অপকর্মের হাতিয়ার ছিল আপেল, আফসার, জাহিদ, বাবুল, তুষার, ইসরাফিল, শামীম, ইমন, সুমন।

মন্ত্রীত্বের ক্ষমতা পাওয়ার পর তিনি যা বলতেন তাই হতো- এমন মন্তব্য করেছেন তার ইউনিয়নের বাসিন্দা শরিফ। তার পরিবারের সদস্যরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন বাণিজ্য, দলীয় পদ বাণিজ্য, চাকরি দেওয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু এই জাতীয় নির্বাচনের পর মন্ত্রীত্ব না থাকায় বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। অধিকাংশ নেতা তার কাছ থেকে দূরে চলে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, প্রতিটি ইউনিটের নেতাকর্মীরা তার কাছে ধরাশায়ী ছিলেন। কেউ তার বাইরে গিয়ে কিছু করার দুঃসাহস দেখাতে পারতেন না। আর এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তার স্ত্রী ও ছেলে শুভ্র। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল তারা বিদেশ থেকে দেশে এলে কয়েক ঘণ্টা আগেই নেতাকর্মীরা ফুল নিয়ে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতেন। আর তার নির্বাচনী এলাকায় এলে তো কথাই ছিল না। তার সঙ্গে থেকে অনেক ছাত্রলীগের নেতা কোটিপতি হয়ে গেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস জানান, তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন এটা আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি। স্থানীয়ভাবে তার বিরুদ্ধেও মানুষকে হয়রানিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে সাবেক এই মন্ত্রী ও তার ছেলেমেয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুশীল সমাজের দাবি তার অবৈধ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করা হোক। এছাড়া, অপকর্মসহ বিভিন্ন মানুষকে যে হয়রানি করেছেন সে বিষয়ে সঠিক বিচারের দাবি জানান তিনি।

এদিকে গুঞ্জন উঠেছে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের আগেই ব্যাংককে পাড়ি জমিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত ১৪ জুলাই বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্ক রোডের বাসা থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককে চলে যান তিনি।

.
BBS cable ad